ক‍্যামেরাম‍্যান শ্রী বৈদ‍্যনাথ বসাক আজ অসহায় ও ভিক্ষুদের সঙ্গে রোজ খাওয়াদাওয়া সারেন

সত্যজিৎ চক্রবর্তী খবর ২৪: হরড়া কলকাতা,রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের অন্নপূর্ণা প্রকল্পে প্রতিদিন দুপুরে পঞ্চাশের বেশি লোককে খাওনো হয়, তাদের মধ্যে অনেকেই আসেন। তাদের মধ্যে ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সম্বলহীন মানুষ। পঙ্‌ক্তিভোজনে রোজই সামিল হন আরও একজন, তিনি হলেন একজন অতীতের বহু সিনেমার সাক্ষী ক্যামেরাম্যান যেমন উত্তম কুমার ও রাজকুমার মহা নায়কদের ছবিতে ক্যামেরাম্যানের কাজ করেছেন আর আজ এক বেলা দুপুরের পেট ভরতে দুকিমি আসতে ও যেতে দুকিমি পথ পায়ে হেটে, কিছু কম খেয়ে একটা গাছের তা পুঁটলি করে নিজের আস্তানায় ফিরে আসে হায়রে আমাদের রাজ্যের একজন প্রতিষ্ঠিত ক্যামেরাম্যানের দুরবস্থা। যদি একটু গরম ভাত মেলে যাঁদের সঙ্গে রোজ খান, তাঁরা তাকে চেনেন না। পড়শিদের কাছেও তাঁর বিশেষ কোনও পরিচয় নেই।তিনি বৈদ্যনাথ বসাক। বয়স আশি ছাড়িয়েছে। শরীরে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। উত্তমকুমারের বহু ছবির ক্যামেরাম্যান বৈদ্যনাথ এখন ধূসর নেগেটিভ।বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক। ‘বুট পালিশ’ ছবি প্রযোজনা করছেন রাজ কাপুর। সেই ছবিতেই ক্যামেরাম্যান ছিলেন তরুণ বৈদ্যনাথ। পরের বছরই রাজকাপুর নিজেই পরিচালনা করবেন ‘শ্রী ৪২০’। তরুণ বৈদ্যনাথকে সেই ছবিতে ক্যামেরায় থাকার জন্য রাজ কাপুর আমন্ত্রণ জানালে ও তাতে অসম্মতি জানান বৈদ্যনাথ। বম্বে ছেড়ে ততদিনে তিনি ফিরে এসেছেন কলকাতায়। চুক্তি করেছেন অগ্রদূত পরিচালিত উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘অগ্নিপরীক্ষা’র জন্য। সিনেমাটোগ্রাফিতে বিভূতি লাহা এবং বিজয় ঘোষের নেতৃত্বে ক্যামেরার কাজ শুরু করলেন বৈদ্যনাথ বসাক। যুক্ত হন অগ্রদূতের সঙ্গে। এখন বয়সের ভারে কানে শুনতে পান না। ঝাপসা হয়ে গিয়েছে দৃষ্টিশক্তিও। মাঝেমধ্যেই বেইমানি করে স্মৃতিশক্তিও। তবুও খানিক ভেবে যখন মনে করতে পারেন পুরোনো কথা, শিশুর মতো হেসে ওঠেন প্রবীণ বৈদ্যনাথ। তাঁর কথায়, ‘সবার উপরে, লালু ভুলু, সাগরিকা, সোনার খাঁচা, সূর্যসাক্ষী, অগ্নিপরীক্ষা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ছদ্মবেশী, নায়িকা সংবাদ, বাদশা, অপরাহ্নের আলোর মতো বহু ছবিতেই কাজ করেছি। ক্যামেরায় ও সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে। শুধু বাংলাই নয়, ক্যামেরায় কাজ করেছেন বুট পালিশ, হরিয়ালি অউর রাস্তা, কিতনে পাস কিতনে দূর-র মতো হিন্দি ছবিতেও।টলিউডেরও বিস্মৃতির অতলেই চলে গিয়েছেন বৈদ্যনাথ। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে উত্তমকুমারের বহু ছবির নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা তথা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের প্রাক্তন তারকা রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়। তখনই সাবিত্রী বলেন, ‘পারলে বৈদ্যনাথ বসাকের জন্য কিছু করুন। উত্তমকুমারের সবচেয়ে বেশি ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন উনিই। আজ উনি বড় কষ্টে রয়েছেন।’ নবীন পরিচালক রাজ বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করেছেন ‘পাড়’। সেই ছবিতে অশীতিপর বৈদ্যনাথ বসাককে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। রাজের কথায়, ‘ওই কাজটি করার সময়েই ওঁর কাজ থেকে শুনেছি, উত্তমকুমারের ৭২টি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।’ তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর কয়েক তিনি ছিলেন নেপালের রাজপরিবারের আলোকচিত্রীও। নেপালের অস্থির পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কথা ভেবেই কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন বৈদ্যনাথ। রাজা মহেন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনি রয়্যাল গেস্ট হাউসে থাকুন। ২৪ ঘণ্টার জন্য আপনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে রাজপরিবারের নিরাপত্তারক্ষীরা।’নোনা ধরা দেওয়াল আর মলিন বিবর্ণ আসবাবপত্রে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। বছর পনেরো আগে স্ত্রী সরস্বতী প্রয়াত হয়েছেন। এখন ছেলের সঙ্গেই থাকেন। ছেলে সঞ্জয় বসাক এক ডেকরেটর্সের দোকানের সামান্য আয়ের কর্মচারী। স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে তাঁরও অভাবের সংসার। তার মধ্যেই একফালি জায়গা বৈদ্যনাথের রাতের আস্তানা। রাতে সামান্য যেটুকু খান, তা বাড়িতেই। নিজেই বলেন, ‘তখন পিকচার কনট্রাক্টে কাজ হত। টাকাপয়সাও যে খুব বেশি পাওয়া যেত তা নয়। তবে, বাকিদের থেকে আমি খানিক বেশিই পেতাম। যা করেছি, সংসারের জন্যই।শরীর বলছে, ভালো নেই। রোজনামচা বলছে, ভালো নেই। আর্থিক হাল বলছে, ভালো নেই। তবু কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। চশমার আড়ালে স্থির তাকিয়ে থাকে দুটি চোখ। বছরের পর বছর ক্যামেরার লেন্সের পেছনে জেগে থাকা সেই দু’টি চোখ। হায়রে মি বিচিত্র এই রাজ্য। আমার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসন, কি এই ক্যামেরাম্যানের একটা গতি করার ব্যবস্থা করতে পারেন।