‘ লকডাউনই বাবার মৃত্যুর কারণ’, করোনা বিপর্যয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অসহায় কৃষকরা

নিজস্ব সংবাদদাতা খবর ২৪: ২২ বছরের রাশপাল সিং চোখের জল মুছে বলে উঠলেন, ”লকডাউনই আমার বাবার জীবন কেড়ে নিল।” রাশপালের মত পঞ্জাবের ছোট্ট গ্রাম সির্সিওয়ালার বহু বাসিন্দার জীবনই লকডাউনে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে গিয়েছে! করোনা পর্বের শুরুতেই ঋণে ডুবে ছিলেন রণধীর সিং। হতাশা, ভয় নিয়ে তার তুলো চাষের ছোট জমিটির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এক বিঘা জমির তুলো চাষের খরচ তোলার মত উৎপাদন অসম্ভব। লকডাউনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার আয়ের অন্য পথ… বাস চালানো। মে-মাসের শুরুতে আর্থিক অনটনের আশঙ্কায় তিনি আত্মঘাতী হন।কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনা মোকাবিলায় দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেন। এই লকডাউন ছিল বিশ্বের কঠোরতম লকডাউনগুলোর একটি। ব্রাজিলকে সরিয়ে বিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় ভারতের স্থান এখন দ্বিতীয়। অর্থাৎ লকডাউনের পরেও দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেমন ঊর্দ্ধমুখী, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশের ছোট চাষী ও কৃষি শ্রমিকদের দুর্দশার মাত্রাও। পঞ্জাবের মত রাজ্যে করোনার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে সর্বত্র লকডাউন জারি করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউনের ফলে সাধারণ পরিবারগুলো আরও দারিদ্র্যের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে! খবরের শিরোনামে উঠে আসছে বাধ্য হয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে চাষীরা।আমাদের দেশে চাষীদের আত্মহত্যা নতুন নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক অতিমারীর ফলে এই দুর্দশা নতুন করে ভয়াবহ আকার নিয়েছে । এই সমস্যার মূলে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করলেন দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিকাশ রাওয়াল। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ভারতে কৃষি দুর্দশার ওপর তিনি গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, গত কয়েক মাসের মধ্যে বহু চাষী ও কৃষি শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন। তৃতীয় দফার লকডাউন শুরু হওয়ার পর রণধীর নিশ্চিত হয়ে যান, এই বিশাল ঋণ শোধ করা তার পক্ষে অসম্ভব। চোখের জল মুছতে মুছতে তাঁর বিধবা স্ত্রীর একটাই প্রশ্ন, “এখন তাঁদের ভবিষ্যত কি? কে খাওয়াবে তাদের?”ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-এ ভারতে চাষী ও কৃষিশ্রমিকদের আত্মঘাতী হওয়ার সংখ্যা ১০,২৮১ জন। এই আত্মহত্যার হার সারা বিশ্বে সর্বাধিক। এখনও ভারতে আত্মহত্যা একটি অপরাধ, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই পথে হাঁটতে বাধ্য হওয়া মানুষদের প্রকৃত সংখ্যাটি অনেক বেশি, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনি ঝামেলার হাত থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ মানুষ কোনও রিপোর্ট লেখান না। অধ্যাপক রাওয়াল বলেন, আত্মঘাতী চাষীদের প্রকৃত সংখ্যাটি জানা খুবই কঠিন, কারণ, লকডাউনের জন্য মিডিয়া বহু জায়গায় পৌঁছতে পারছে না। আকানওয়ালি গ্রামের লীলা সিং-এর ছেলে বললেন, তাঁর বাবা ক্ষেতটি বাঁচানোর জন্য ১ হাজার টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ঋণ শোধে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি আত্মঘাতী হন। জুন মাসের প্রথমদিকে মোদি সরকার ঘোষণা করেছিল, কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে, তাঁদের লাভ বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে বেসরকারিকরণ করা হবে। কিন্তু অগাস্টে প্রায় হাজার জন কৃষক ঘোষণার প্রতিলিপি রাস্তায় জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁদের মতে, চাষীদের স্বার্থরক্ষার পরিবর্তে এই নিয়ম একচেটিয়া কারবারিদের সুবিধে করে দেবে। সম্প্রতি ১২ জন মহিলা নির্মল সিং-এর গ্রামে একটি পুরনো প্রথা পালন করেন, যাতে ভগবান সন্তুষ্ট হয়ে বৃষ্টি নামায়। তাঁরা মিছিল করে শুকনো ডাল-পাতা ও রেশমের কাপড়ের পুতুল জ্বালিয়ে, বুক চাপড়ে একসঙ্গে গান গাইতে থাকেন। এরপর গ্রামে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় অনেকেই স্বস্তি পান।

